চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে বৃহস্পতিবার মুখোমুখি হতে চলেছে দুই প্রতিবেশী – ভারত এবং বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মূলধারার গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যম – দুই জায়গাতেই এই দুই দেশের ম্যাচ নিয়ে গোটা উপমহাদেশেই ব্যাপক চর্চা হয়ে থাকে। এই সেমিফাইনাল ম্যাচ নিয়েও স্বাভাবিকভাবেই চর্চা চলছে।
একদিকে যেমন ক্রিকেট লিখিয়েরা বিশ্লেষণ করছেন গণমাধ্যমে, যেখানে ভারতকে শক্তিশালী দল হিসাবে দেখানো হলেও বাংলাদেশ সাম্প্রতিক কালে যেসব ইন্দ্রপতন ঘটিয়েছে, উল্লেখ থাকছে সেগুলোরও।
অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যমে গত কয়েকবারের মতোই এবারও শুরু হয়েছে একে অপরকে ব্যঙ্গ করা এবং কুকথা বলা।
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারত খেলতে যাওয়ার পর থেকেই সংবাদমাধ্যমে ম্যাচ রিপোর্ট বা বিশ্লেষণ তো থাকছিলই, কিন্তু বেশী গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছিল – এমন কি অনেক সময়ে প্রথম পাতাতেও জায়গা করে নিচ্ছিল ভারতের কোচ আর ক্যাপ্টেন – কুম্বলে এবং কোহলির মনোমালিন্য।
সংবাদসংস্থা আই এ এন এসের পূর্ব ভারতের সম্পাদক ও সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক শীর্ষেন্দু পন্থ বলছিলেন, “বৃহস্পতিবারের ম্যাচটাকে একটা মহারণ হিসাবেই দেখছে ভারতের সংবাদমাধ্যম। ভারত ইংল্যান্ডে খেলতে যাওয়ার পর থেকেই কুম্বলে বনাম কোহলির খবরই বেশী দেখা যাচ্ছিল।”
“কিন্তু গত কয়েকদিনের সংবাদপত্রে দেখা যাচ্ছে যে বৃহস্পতিবারের ম্যাচের ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণই বেশী থাকছে। ফেভারিট হিসাবে অবশ্যই নিজের দেশকেই দেখাচ্ছে ভারতের মিডিয়া, কিন্তু বাংলাদেশের সাফল্যগুলোকেও খুবই গুরুত্ব দিয়ে লেখা হচ্ছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের কাছে ভারতের সিরিজ পরাজয়, বা গতবছর টি২০ ওয়ার্ল্ড কাপে একরানের জয় – এসব তথ্যও দেওয়া হচ্ছে।”
ভারত আর বাংলাদেশ – দুই দল কে কোথায় সবল, কোথায় তাদের দুর্বলতা সেগুলো যেমন থাকছে বিশ্লেষকদের কলমে, তেমনই উল্লেখ করা হচ্ছে যে বাংলাদেশ বিগত বছরগুলিতে যেভাবে দ্রুত উন্নতি করেছে, কবে কীভাবে কাকে হারিয়ে ইন্দ্রপতন ঘটিয়েছে, সেইসব তথ্যও।
প্রবীণ ক্রীড়া সাংবাদিক জয়ন্ত চক্রবর্তী বলছিলেন, “ভারতের গণমাধ্যমে যেসব বিশ্লেষণ বেরচ্ছে বৃহস্পতিবারের ম্যাচ নিয়ে, তার মধ্যে অনেকগুলোই লিখছেন প্রাক্তন ক্রিকেটাররা। শক্তির দিক থেকে ভারতকে তাঁরা এগিয়ে রাখছেন বটে কিন্তু বাংলাদেশকে কেউ রাইট-অফ করে দিচ্ছেন না।”
“লেখকরা মোটেই বাংলাদেশকে হীনবল বলে মনে করছেন না। তারা লিখছেন যে ভারত যদি আত্মতুষ্টিতে ভোগে, তাহলে কালকের ম্যাচ বার করা কঠিন। বাংলাদেশের পোটেনশিয়ালের কথা সকলেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন বার বার।”
মূল ধারার গণমাধ্যমে যখন ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণ চলছে, তার মধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে মূলধারার মাধ্যমেও ব্যঙ্গ করার মতো খবরও বেরচ্ছে।
সামাজিক মাধ্যমে প্রচুর শেয়ার হওয়া একটি ব্যঙ্গচিত্র – যেখানে একটি বাঘ একটি কুকুরকে তাড়া করছে দুই দেশের পতাকা নিয়ে বলে দেখানো হয়েছে, সেটির সমালোচনাও বেরিয়েছে আজকের জাতীয় কয়েকটি দৈনিকে।
সামাজিক মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের ম্যাচের আগে বা পরে সমর্থকদের মধ্যে যে ব্যঙ্গ করা ও একে অপরকে কটু কথা বলার চল, সেটা শুরু হয়েছে কয়েক বছর ধরে।
সামাজিক মাধ্যমের ওপরে নজর রাখেন কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিউটের শিক্ষক গর্গ চ্যাটার্জী।
তিনি বলছিলেন, “ব্যঙ্গচিত্র শেয়ার করা বা কটু কথা তো বলা হচ্ছেই কয়েক বছর ধরে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ নিয়ে ঠিক কী কী বলা হয় সামাজিক মাধ্যমে। একদিকে যেমন ইন্ডিয়া নামটিকে বিকৃত করে লেখা হয় বাংলাদেশের দিক থেকে, তেমনই ওদেশের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়াকে কটূক্তি করে বাংলাদেশের নামও বিকৃত করে অনেক ভারতীয়রা।”
“এই সব মন্তব্য বা ছবি বা কার্টুন একটা নোংরা দিকে চলে যায় একেক সময়ে – একে অপরের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে, গরীবের প্রতি ঘৃণা, নারীদের প্রতি ঘৃণা – সেগুলোর সঙ্গে যৌনতা মেশানো কমেন্ট করা হয়। তার সঙ্গে অবশ্যই সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মীয় প্রসঙ্গও চলে আসে।”
“আসলে এই উপমহাদেশের তিনটে দেশই তো সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে, তাই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে রাজনীতির ক্ষেত্রে যেমন, তেমনই রাষ্ট্রীয় স্তরের ক্রীড়া প্রতিযোগিতাগুলোর সময়েও ওই ধরনের মন্তব্য আসে। খেলার সময়ে যেসব কটূক্তি করা হয়, সেগুলোকে তাই আলাদা করে দেখলে হবে না,” বলছিলেন মি. চ্যাটার্জী।
বর্ষীয়ান ক্রীড়া সাংবাদিক জয়ন্ত চক্রবর্তীরও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এইসব ব্যঙ্গ চিত্র বা কটু কথা নজর এড়ায় নি।
তিনি বলছিলেন, “একটা সিনেমা বা থিয়েটার হলে কিছু অন্তরঙ্গ দৃশ্য দেখে অনেক দর্শক পয়সা ছোঁড়ে বা সিটি বাজায়। এই যারা সামাজিক মাধ্যমে কটু কথা বলতে থাকে খেলার সময়ে, বা খারাপ কার্টুন শেয়ার করে, তাদের আমি ওই সিটি বাজানো দর্শকদের পর্যায়ে ফেলি। এরা না বোঝে খেলা, না বোঝে দুই রাষ্ট্রের সম্পর্ক, না বোঝে ক্রীড়া বা সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের ইতিবাচক দিকগুলো। এরা সস্তা জনপ্রিয়তা আর উন্মাদনা খোঁজে।”
ভারত-বাংলাদেশের সমর্থকদের মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে যাই চলুক না কেন, মাঠে দুই দলই যে বেশ চাপে থাকবে, সেটাও লেখা হচ্ছে ভারতীয় গণমাধ্যমে। বলা হয়েছে, ইংল্যান্ডের মাঠ যদিও ভারতের পক্ষে পয়মন্ত, কিন্তু বৃহস্পতিবার দুই দলের মধ্যে যে সেই চাপ সহ্য করতে পারবে, সেই সফল হবে।